
শীর্ষা সেন // ৭৪ পল্লী সার্বজনীন দুর্গোৎসব খিদিরপুর : ৬৪ বছরে পা দিল এবছরের ৭৪ পল্লী সার্বজনীন দুর্গোৎসব খিদিরপুর। বাকি বছরের মতো এবছরের পুজোয় ও তাঁরা এক নতুন ধরনের বিষয় নিয়ে আসতে চলেছে বাংলার প্রাচীন ও জনপ্রিয় বাদ্যযন্ত্র ঢোল। এবছরের তাঁদের বিষয় ভাবনা ‘বাংলার ঢোল’। ঢোল এর মাঝের অংশ হয় ফাঁকা। মানুষের তৈরি এই ঢোল সচেতন আর অচেতন-এর মেলবন্ধন ঘটায়। ঢোল –এর মাঝের অংশ ফাঁকা সেই স্থানেই আদি শক্তির আবির্ভাব ঘটে। ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলনই তুলে ধরবেন শিল্পী নির্মল মল্লিক।
চেতলা অগ্রণী ক্লাব : দেখতে দেখতে ২৭ বছরে পদার্পণ করেছে চেতলা অগ্রণী ক্লাব। তাঁদের এবারের নিবেদন ‘কলকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে’। ৩০০ বছরের ও বেশি সময় ধরে কলকাতা মহানগরী চলছে নিজের ছন্দে। নগরীর অতীত- বর্তমান- ভবিষৎ সবই যুক্ত এখানকার মানুষের সাথে। কত মনীষী এই মহানগরীর সাথে সাথে চলেছেন।মন্বন্তর, দেশভাগ দাঙ্গা সব নিয়েই আমাদের শহর কলকাতা। অতীতের মধুর ও তিক্ত সব স্মৃতিই তুলে ধরবেন তাঁরা। কলকাতার নস্টালজিয়া তুলে ধরেছেন এবারের চেতলা অগ্রণীর শিল্পী অনির্বান দাস প্যান্ডেলওয়ালা। এছাড়া তাঁর এই পরিকল্পনা কে সম্পূর্ণ রূপ দান করার জন্য আলোক পরিকল্পনায় সহযোগিতা করবেন শ্রী প্রেমেন্দু বিকাশ চাকী মহাশয়।তাঁদের এবারের পরিকল্পনা যে অন্য বছরের তুলনায় ভিন্ন তা বলার অপেক্ষা রাখে নাl এবারে তাদের পরিকল্পনা কতটা সফল হবে তাই দেখার।
২৫ পল্লী ক্লাব : ৭৫ বছরে পা দিল ২৫ পল্লী ক্লাব। তাদের এবারের উদ্যোগ ‘দহন ‘. পুড়ছে ধরণী পুড়ছে আমাদের প্রকৃতি। শুধু তাই নয় নিঃশেষ হচ্চ্ছে প্রাকৃতিক সম্পদ। নিঃশেষ হচ্ছে প্রাণীকুল। পরিবেশ দূষণের ফলে বেড়েছে উষ্ণতা, কমেছে ঋতুসংখ্যা। হেমন্ত আর বসন্ত এখন চোখেই পড়েনা। চোখে পড়েনা চড়ুই পাখি। প্রাণীর বৈচিত্র কমছে দিনের পর দিন । বাড়ছে কলকারখানা, বাড়ছে শপিং মল ও বহুতল। বৃক্ষ নিধন চলছে নির্বিচারে। আমাদের এখনই সচেতন হওয়া উচিত এখনই। মানুষের মাঝে চেতনার বিকাশের প্রয়োজন , প্রয়োজন সচেতনতার। সনাতন দিন্ডা তাঁর এই প্রচেষ্টাই নিয়ে আসছেন ২৫ পল্লী ক্লাবে। এই সামাজিক বার্তা মানুষের মনন এ প্রোথিত করতে চান তিনি। প্রকৃতিকে আমরাই বাঁচাতে পাড়ি তাঁর প্রচেষ্টা আমাদেরই করতে হবে তার অঙ্গীকার আজই প্রয়োজন।
খিদিরপুর পল্লী শারদীয়া : ৭৮ বছরে পা দিল এবছরের খিদিরপুর পল্লী শারদীয়ার পূজা।এবছরের তাঁদের বিষয় ভাবনা ‘ব্যারিকেড বা অবরোধ’. বাধা দুই প্রকারের। ব্যাক্তিগত এবং রাষ্ট্রীয়। সমাজে প্রতিনিয়ত অতিক্রম করতে হয় এই বাধা। সাফল্য অর্জনে প্রয়োজন বাধার,দেবী দুর্গাও অনেক বাধা অতিক্রম করে আসেন মর্তে , সে কাহিনী পূরণে বর্নিত। অশুভ শক্তির বিনাশ করে শুভ শক্তির প্রতীক রূপে আসেন দেবী উমা. জীবনের অনেক বাধা পেরিয়ে সফল হওয়ার নামই জয়ী হওয়া।বাধা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয় মানুষকে। সেই সচেতনতা গড়ে তুলতে চান তাঁদের শিল্পী রবীন রায়. এই প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে মানুষ কে সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছেন খিদিরপুর পল্লী শারদীয়া।
হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব সমিতি :৭৭ বছরে পা রাখল হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব। তাদের এবারের নিবেদন ‘পুজোর পাসওয়ার্ড’. আমাদের রোজকার জীবন একটি ছন্দে বাধা। সকালে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত একই সুতোয় বাধা। আমাদের সব কিছুই চলে এখন অনলাইনে। প্রযুক্তি ছাড়া একদিন ও কাটানো যেনো দুর্বিষহ মনে হয়। আমরা রোজকার প্রযুক্তিতে এতটাই জড়িত যে আমরা ভুলে গেছি আমাদের সুখ দুঃখ এবং আনন্দ।আমাদের অনুভূতি গুলি যেন দিনের পর দিন বাক্স বন্দি হয়ে চলেছে। পুরোপুরি যন্ত্র হয়ে যাবার আগে আমাদের প্রয়োজন একটু বিরতির , প্রয়োজন নতুন করে অনুভূতিতে সারা দেওয়া। তাই পুজোর কটা দিন যেন আমাদের পাসওয়ার্ড হয় মা দূর্গা তার প্রচেষ্টাই নিয়ে আসছেন হাজরা পার্ক দুর্গোৎসব সমিতি। তাঁদের এবারের মণ্ডপ শিল্পী তন্ময় চক্রবর্তী। তাঁর হাতের স্পর্শেই সেজে উঠবে এবারের মণ্ডপ।
আলিপুর সার্বজনীন : ৭৪ বছরে পদার্পন করল আলিপুর সার্বজনীন। তাদের এবারের পরিকল্পনা ‘সেফ ড্রাইভ সেভ লাইফ’. সরকারি উদ্যাগ তো অনেকেই দিন থেকেই চলছে। দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় সমস্ত নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছেন সরকার কর্তৃপক্ষ। সাধারণ জনগণ-এর সুরক্ষা স্বার্থে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে । তাই মানুষ কে সচেতন করতে এই উদ্যোগ নিয়েছেন আলিপুর সার্বজনীন- এর কর্মকর্তারাও। তাদের এবারের মণ্ডপসজ্জার শিল্পী শক্তি শর্মা। অন্যবারের মতো তাদের এবারের প্রদর্শনী সম্পর্কে জানতে হলে আসতে হবে তাঁদের পূজা প্রাঙ্গনে।
চেতলা সর্বসাধারণের দুর্গোৎসব : ৯১ বছর পেরিয়ে ৯২ বছরে পা দিল চেতলা সর্বসাধারণের দুর্গোৎসব। তাদের এবারের নিবেদন গুজরাতের বিখ্যাত শিপ লিপ্পান। ভগবতী দূর্গা এই জগতের মূলশক্তি। তিনিই প্রধান প্রতিপালিতা এই ভুবনের। তিনি দুষ্টের বিনাশ এবং শিষ্টের স্থাপনা করেন এই বিশ্বে। তাদের এবারের নিবেদন এ আমরা ভগবতী দূর্গার রূপ দেখতে পাবো।তাছাড়া গুজরাটের নারীদের এই অনবদ্য শিল্পকলা তো উপরি পাওনা। গুজরাটের কচ্ছের রাবাড়ি জনজাতির আদিবাসী নারীরা তাদের ঘরের তাপমাত্রা নিম্ন রাখার জন্য দেওয়ালে কাদা ও গৃহপালিত পশুর মলের মিশ্রনের উপর কাঁচ-এর টুকরো দিয়ে সুন্দর কারুকার্য করেন তাই হল লিপ্পান শিল্প, যা বিশ্বব্যাপী প্রখ্যাত। শিল্পী রঞ্জিত দাস এর হাটি ধরে রূপ পাবে এই পূজা মণ্ডপ।
কালীঘাট মিলন সঙ্ঘ : দীর্ঘ ৭৪ বছরের পথ পেরিয়ে ৭৫ বছরে পা দিল কালীঘাট মিলন সংঘ। তাঁরা গোটা পৃথিবীর পরিধির সঙ্গে তুলনা করেছেন মানব জগতের। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব জগৎ-এ তাঁরা বিচরণ করে। আমাদের ভাবনা চিন্তা আর আসে পাশের পরিবেশের পরিস্থিতির কারণে আমাদের মধ্যে যে প্রভাব পড়ে তা কখন সুন্দর সতেজ কখনো বা ধূসর। সকল প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে মানুষ নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ করে , তাঁরা তাদের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই বার্তাই প্রদান করতে চাইছেন। তাদের এবছরের নির্ধারিত ব্যয় হল কমপক্ষে ২০ লক্ষ টাকা। এই প্রচেষ্টা যার হাত ধরে রূপ পাবে সেই শিল্পী হলেন শ্রী গৌরাঙ্গ কুইল্লা।তাদের এই পরিকল্পনার বাস্তবায়িত রূপ দেখতে পাব কালীঘাট মিলন সংঘের পূজা মন্ডপে।
উদয়ন খিদিরপুর : ৭৩ তম বর্ষে পা রাখল উদয়ন খিদিরপুর। তাঁদের এবারের নিবেদন ‘সৃষ্টির কান্না ‘ . উদয়ন খিদিরপুর -এই পরিকল্পনা কে বাস্তবায়িত করবেন শিল্পী শীতাংশু তাঁতি।আমাদের প্রতি দিনের সাথে জড়িত রয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার একের পর এক সীমা অতিক্রম করছে। প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে দিনযাপনের পদ্ধতি। বিজ্ঞানের এক আবিষ্কার প্লাস্টিক সেটি আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ সে নিয়ে এখন ও বিতর্ক রয়েছে। কারণ এক সময়ে তা মানুষ কে সাহায্য করলেও এখন তা প্রাণীকুলের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। স্থলভাগ জলভাগ সবই দূষিত করছে এই প্লাস্টিক। প্লাস্টিকের কারণে মারা যাচ্ছে বিভিন্ন জলজ উদ্ভিদ। এখনই আমাদের এই নীল গ্রহের প্রাণের উৎস জলকে রক্ষা করা উচিত। সমাজ কে এই বার্তা দিতেই আসছে তাঁদের এবারের শারদ ভাবনা। এবছর আনুমানিক ৬ লক্ষ টাকা তাঁরা ব্যয় করছেন তাঁদের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করতে।
খিদিরপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব : দেখতে দেখতে ৯২ বছরে পা রেখেছে খিদিরপুর সার্বজনীন দুর্গোৎসব। তাঁদের এবারের ভাবনা ‘পুজোটাই জলে’. সাধারণত পুজোটাই জলে বলতে আমরা বুঝি পুজোর আনন্দ মাটি হওয়া। কখনও সেটা হয় আবহাওয়ার জন্য কখনো বা অন্য কোনো কারণে।সেচ্ছাচারে বৃক্ষ নিধন হবার ফলে বদলেছে ঋতুচক্র। তাই আজ আমাদের পৃথিবী বিপন্ন। প্রকৃতির জলের ভান্ডার প্রায় নিঃশেষ এর পর্যায়। তাঁরা তাঁদের পরিকল্পনার মাধ্যমে জনগন কে এটাই জানাতে চান বৃষ্টির জলের সংরক্ষণ প্রয়োজন। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবেন তাদের শিল্পী অনিকেত বর্ধন। তাঁদের পুজোর আনুমানিক বাজেট সাড়ে ৫ লক্ষ টাকা।