বিশ্বকর্মার মুখভার : নেই আনুন্দ , হচ্ছে না ফাংশান, চা বিস্কুট ও লাড্ডুতে থাকলো আটকে !
বিশ্বকর্মা পুজো দিয়েই শুরু হয় বাংলার শারদ উৎসব , তারা তলা , হাইরোড , বিটি রোড যশোর রোড সহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর আজ যেন মৃত্যু পুরী। বড় কারখানা দাঁড়িয়ে শেষ নিঃস্বাস ছাড়ছে।শ্রমিক কর্মচারীরা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে।

দেশভাগের পর পূর্ববঙ্গ থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এই ব্যাপক অভিবাসনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা দেখা দেয়। ১৯৫০ সালে দেশীয় রাজ্য কোচবিহারের রাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ ভারত সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হলে কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। ১৯৫৫ সালে ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। বিহারের কিছু বাংলা-ভাষী অঞ্চলও এই সময় পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়।
১৯৬০ ও ১৯৮০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিপর্যয়, ধর্মঘট ও মালিক পক্ষের একতরফা মুনাফাতে কেন্দ্রীয় সরকারের সায় । এর ফলে এক অর্থনৈতিক স্থবিরতার যুগের সূত্রপাত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেয়। সেই সময় নকশালবাদের সাথে কংগ্রেসের চক্রান্তের ফলে রাজ্যের পরিকাঠামোয় গভীর চাপ সৃষ্টি হয়। ১৯৭৪ সালের বসন্ত মহামারীতে রাজ্যে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ১৯৭৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক পরিবর্তন সূচিত হয়। এরপর তিন দশকেরও বেশি সময় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যে শাসনভার পরিচালনা করে।শিল্প ও শ্রমিকদের সার্বিক অবস্থার নতুন দিক উন্মোচিত হয়।তৎকালীন কেন্দ্র সরকারের শিল্পনীতির ফলে সারা ভারত বর্ষের শিল্পে বিনিয়োগের পরিমান কমে যায়। বাংলায় বাম সরকার অনেক গুলি বেসরকারি শিল্প সরকারি ভাবে হাতে নেবার ফলে সাময়িক মন্দার হাত থেকে বাঁচলেও বর্তমানে তার সলিল সমাধি হয়েছে।
১৯৯০-এর দশকের মধ্যভাগে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক সংস্কার এবং ২০০০ সালে সংস্কারপন্থী নতুন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নির্বাচনের পর রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। বাম আন্দোলন ও শ্রমিকদের অধিকার সঙ্গে বিনিয়োগের পরিবেশ গড়ে উঠলেও , বিরোধীদের লাগাম ছাড়া আন্দোলনে টাটার মত শিল্পকেও এই রাজ্য থেকে বিদায় নিতে হয় যা আজ মানুষ হারে হারে বুঝছে।এর পাশাপাশি বহু শিল্পপতি এই বাংলায় বিনিয়োগের জন্য যখন মনস্থির করেছেন তখনই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে মানুষের আবেক কে সঙ্গে করে সিঙ্গুর নন্দী গ্রামে যে ঘটনা ঘটেছে তার মাসুল আগামী ২০ বছর এই বাংলাকে দিতে হবে বললেন সি আই টি ইউ এর রাজ্য সভাপতি সুভাষ মুখার্জী।এছাড়াও সেই সময় রাজ্যের বিভিন্ন অংশে ছোটোবড়ো বেশ কয়েকটি সশস্ত্র জঙ্গিহানার ঘটনা ঘটেছে। আবার শিল্পায়নের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় অধিবাসীদের একাধিক সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। ফলে শিল্পতিদের ধারণার বদল হয়ে যায়।
এরপর ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচন ও ২০১০ সালের পৌরনির্বাচনে শাসক বামফ্রন্টের আসন সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে।২০০৬ সালে হুগলির সিঙ্গুরে টাটা ন্যানো কারখানার জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিপক্ষের সহায়তায় স্থানীয় কৃষকদের মধ্যে তীব্র গণ-অসন্তোষ দেখা যায়। জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের প্রেক্ষিতে সিঙ্গুর থেকে টাটা গোষ্ঠী কারখানা প্রত্যাহার করে নিলে, তা রাজ্য রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। ২০০৭ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে অশান্তির জেরে পুলিশের গুলিতে ১৪ জন মারা গেলে রাজ্য রাজনীতি ফের উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অবশেষে ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হয়ে রাজ্যের ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসান হয়।বর্তমানে এই নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুর মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।কারণ বিগতদিনের বিরোধী নেত্রী সাঙ্গুর ও নন্দী গ্রামের সফল আন্দোলন কারী যে বিপদ ডেকে এনেছেন এই রাজ্যে তা আজ মানুষ বুঝছে প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে।
বাম আমলে ছোট শিল্পের সংখ্যা বেড়ে যায় অনেকাংশেই।আর এর ফলে দেশের বিভিন্ন রাজ্য থেকে শ্রমিক আসার পরিমাণও বেড়ে যায় কাজের সুযোগ থাকায় । সমগ্র রাজ্যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট গড়ে উঠে কয়েকটি জেলা বাদ দিলে প্রায় সব জেলাতেই। কাজের সন্ধানে সমগ্র দেশ থেকে আসা মানুষের পরিমান বাড়তে লাগে। সংঘটিত ও অসংঘটিত ক্ষেত্রে রোজগারের নিরাপত্তায় অনেকাংশেই এগিয়ে যায় পশ্চিম বঙ্গ।তবে কেন্দ্র মাসুল সমীকরণ ও সার্বিক শিল্পনীতির ফলে মন্দ দেখা দেয় সমগ্র দেশে । লাগাতার শ্রমিক আন্দোলের ভুল ব্যাখ্যার ফলে শিল্প ও শ্রমিকের অধিকারের মধ্যে পার্থক্য গড়ে তুলতে সফল হয় বিপক্ষ থাকা রাজনৈতিক দল। ফলে টাটা থেকে বহু বিনিয়োগ কারী মুখ ঘুরিয়ে নেয় এই রাজ্য থেকে ।
দশ বছর অন্তর যেমন জনগণনা হয়, তেমনই ২০০৫ সালে প্রথম বার আর্থিক শুমারি হয়েছিল। দ্বিতীয় আর্থিক শুমারির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৩ থেকে। সম্প্রতি তার প্রাথমিক ফল প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান মন্ত্রক। এই শুমারিতে গোটা দেশে কতগুলি শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থা রয়েছে, সেখানে কত জন কাজ করছেন, তার হিসেব করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন , “যে কোনও সংস্থা যদি কিছু উৎপাদন করে, বিক্রি করে বা পরিষেবা দেয়, তা হলে সেগুলি আমাদের গণনার আওতায় চলে আসে। সেটা বড় কারখানা হতে পারে, আবার কেউ ঘরেই মেশিন বসিয়ে বা হাতে কিছু তৈরি করছেন কিংবা বাড়ির বারান্দায় দোকান দিয়েছেন, সেটাও হতে পারে।”
বাস্তবে ২০১১ থেকে ঘটে করে শিল্প সম্মেলন হলেও আজ পযন্ত সেভাবে শিল্প আসেনি। রাজনৈতিক সমালোচকরা বলছেন সম্মেলন ও শিল্পের জন্য বিদেশ সফরের যে খরচ হয়েছে সেই পরিমান বিনিয়োগ হয় নি এই রাজ্যে। শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার মোট হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে থাকলেও সেই তুলনায় কর্মসংস্থান কিন্তু হয়নি। একজায়গায় বলেছেন পরিসংখ্যান মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (আর্থিক শুমারি) সুনীল জৈন বলেন, “কর্মসংস্থান বৃদ্ধির হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ পিছনের সারির রাজ্যগুলির অন্যতম।” ২০০৫ থেকে ২০১৩-র মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২০.৩৫ শতাংশ। অথচ শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা বেড়েছে ৪১ শতাংশ। গুজরাতে এই আট বছরে নতুন শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা ৬৭ শতাংশ বেড়েছে। কর্মসংস্থানও বেড়েছে প্রায় ৫৬ শতাংশ। জাতীয় স্তরেও এই সময়ে ৩৪ শতাংশ কর্মসংস্থান বেড়েছে।
বর্তমানে শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা বেশি হওয়ার অর্থ হল বড় বা ভারী শিল্পের অভাব। যখন একটা বড় কারখানা বা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, তখন তার শ্রমিকরা পেট চালাতে ছোটখাটো কারখানা, দোকান খুলে বসেন। তার ফলে এই ধরনের সংস্থার সংখ্যাও এক লাফে অনেকটাই বেড়ে যায়।ফলে সংঘঠিত শিল্পের ক্ষেত্রে উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগের পরিমান কমতে থাকে , এর ফলে নতুন কাজ সৃষ্টি হয় নি আর রয়ে যাওয়া শিল্পে চূড়ান্ত মন্দায় কাজ হারিছেন কয়েক লক্ষ্য শ্রমিক কর্মচারী।
এর কারণ কী? আর্থিক শুমারি বলছে, পশ্চিমবঙ্গে ছোট মাপের কারখানা বা ব্যবসা হওয়ার ফলে সেগুলিতে কাজ পাওয়া মানুষের সংখ্যা কম। প্রায় ৫৯ লক্ষ শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থায় কাজ করছেন ১ কোটি ১৫ লক্ষের মতো মানুষ। গড়ে একটি সংস্থায় কাজ করা মানুষের সংখ্যা দু’জনেরও কম-১.৯৬। মহিলা কর্মী-শ্রমিকের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে বাংলা। জাতীয় স্তরে যার পরিমাণ ২৫%, রাজ্যে তা ২১%-র কাছাকাছি। বিশেষগ্যদের বক্তব্য , “আর্থিক শুমারির ফলের পর বোঝা যাবে, বাংলায় আগে ক’টি বড় কারখানা বা বাণিজ্য সংস্থা ছিল, এখন ক’টি ছোট সংস্থা হয়েছে।” আর্থিক শুমারির প্রাথমিক ফলেই ইঙ্গিত, রাজ্যে এখন ছোট কারখানা বেশি। স্থায়ী কাঠামোর মধ্যে কারখানা, ব্যবসা চলছে ৩৫% ক্ষেত্রে। ৫৯ লক্ষের বেশি শিল্প বা বাণিজ্য সংস্থার ৩৬% চলছে বসত বাড়িতে। প্রায় ২৯ % কারখানা বা ব্যবসা চলছে বাইরে, কিন্তু তার নির্দিষ্ট কাঠামো নেই।
বর্তমানের সরকারি যুক্তি আর প্রকাশ করা রিপোর্টে চাপাই করা যুক্তি যাই হোক না কেন বাংলাতে উৎপাদন শিল্প হয় নি যেখানে বাস্তবে ২০০০ কোটি টাকার শিল্প হয়েছে , আর সেখানে বাংলায় ছেলে মেয়েরা কাজ পেয়েছেন শেষের ৮ বছরে। বলা যায় পরিষেবা ধর্মী কিছু কাজের নতুন দিক এসেছে যেমন অন লাইন বাণিজ্যের পরিষেবার ক্ষেত্র।তবে সেই কাজের সামাজিক নিরাপত্তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তবে এটাই কি বিকল্প কাজের বাজার প্রশ্ন পড়াশুনা করা যুবক যুবতীদের। তাই আজকের বিশ্বকর্মা পুজোর বাজারে মন ভার সকলের। রাস্তায় কিছু ছোট কলকারখানা সহ গাড়িমেরামতির গেরেজ থেকে রিক্স , অটো ও বাস মেটাডো স্ট্যান্ডে পুজো হচ্ছে। আর সব মিলিয়ে কারখানার বড় পুজো , ফাংশান , কর্মীদের পরিবারের লোকজনের আনাগোনা সে এক অনন্য পরিবেশ ছিল আজ সবই যেন হারিয়ে গেছে কালের গতিতে।