Culture

২৮৩ বছরে সাবন্য রায়চৌধুরী পরিবারের পুজো : কালীকিঙ্কর ভবন থেকে সরাসরি !

বাংলায় অনেক পরিবারের পুজো হারিয়ে গেলেও আজও প্রবাহমান রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো , নিষ্ঠার সাথে রীতি মেনে চলেছে ২৮৩ বছর

স্মৃতির সরণি বেয়ে রীলে রেসের ব্যাটন এই প্রজন্মের হাতে , ইতিহাস আজও বর্তমান। লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতী দেবী। ভাষা বর্ণ ধর্ম মিলেমিশে মানুষের বাস।কুশলী জমিদার প্রজা বৎসল হিসেবে নিজের মান রাখতে তাঁদের এক সূত্রে বেঁধে রেখে মসৃণ ভাবে নবলব্ধ দায়িত্ব পালনের জন্য এমন একটি পুজোর যে বিকল্প নেই সে কথা বিলক্ষণ জানেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।

সেই সময়ে নতুন রাজনৈতিক অবস্থান তৈরির দিকে এগোচ্ছে , বারো ভুঁইয়ার সময় যখন বাংলার রাজনীতির আকাশে নানা পটপরিবর্তন হচ্ছে, আর সেই সময়ই জমিদার লক্ষ্মীকান্তের উত্থান হয় ।পাশাপাশি যশোর এস্টেটের বসন্তরায় এবং বিক্রমাদিত্য দায়িত্বে ছিলেন বারো ভুঁইয়ার । অমায়িক, সদাহাস্যমুখ বসন্তরায়ের অত্যন্ত কাছের মানুষ বিক্রমাদিত্যর পুত্র প্রতাপাদিত্য এবং লক্ষীকান্ত, দু’জনেই ছিলেন । আর এই লক্ষ্মীকান্ত মহাশয় ছিলেন যশোর এস্টেটের মহামন্ত্রী।এরপর বিক্রমাদিত্য মারা যাওয়ার সময় জমিদারির ভাগবাঁটোয়াতে পূর্ববঙ্গ, অর্থাৎ প্রতাপ যশোহরের দিক পেলেন ,বসন্তরায় পশ্চিম দিক পেলেন । পিতার মৃত্যুর পর প্রতাপ ক্ষমতা ও অর্থের লোভে পিতা সমান বসন্ত রায় কে খুন করে সম্পত্তি হরণ করার চেষ্টা করেন।আকবর এর কিছু দিনের মধ্যেই প্রতাপকে দমন করতে মানসিংহকে পাঠান ।

লক্ষ্মীকান্তকে হালিশহর থেকে আটটি পরগনার নিষ্কর জমিদারি স্বত্ত প্রদান করেন মানসিংহ, সেই সঙ্গে যুদ্ধে প্রতাপ পরাজিত হন ১৬০৮-এ । আর এই ক্ষেত্র ধরেই রায়চৌধুরী উপাধি লাভ করেন । জমিদার বাড়ির পুজো সাধারণত হালিশহরে বছর দু’য়েকের জন্য দুর্গাপুজো করলেও সে বার বড় আকারে বড়িশাতে পুজো শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী।এই পুজোর শুরুর কথা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যা জানা যায় তা হল তাহিরপুরের রাজা কংসনারায়ণ বা ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণের পুজোর যে বর্ণনা পাওয়া যায় সেখানে দেবীমূর্তির সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী বা কার্তিক, গণেশ ছিলেন না। এখানে মূলত দেবীকে চণ্ডী মাতা রূপে পুজো করা হত। জমিদার লক্ষীকান্ত দেবীকে সপরিবার আবাহন করলেন।এক্ষেত্রে পণ্ডিতরা বিধান দিলেন, দেবীর গায়ের রং হতে হবে স্বর্ণাভ বা শিউলি ফুলের বোঁটার মতো।

আর এই পুজোর শুরুর দিকটাই কাঠের থামের উপর হোগলাপাতার ছাউনি দেওয়া আটচালা মণ্ডপে দেবী আরাধনা শুরু হয় ১৬১০ সালে।তবে বেশিদিন মা দুর্গাকে হোগলা পাতার ছাউনিতে থাকতে হয় নি। তৈরি হল ষোলোটি থামবিশিষ্ট একটি নাটমন্দির। কালের গতিতে হারিয়ে গেলেও আজও দেবী শরতের সোনা রং গায়ে মেখে সাবর্ণ পরিবারে আসেন। এখানে বৈশিষ্ঠ হল গণেশ হবেন লাল রঙের ও দেবীদুর্গা পড়েন সবুজ রঙের শাড়ি , দেবীর এক দিকে থাকেন রঘুপতি, অন্য দিকে শিব।

কালের গতিতে পরিবার বেড়ে ওঠার সাথে পরিবার গুলি বিভিন্ন জায়গার বাড়ি তৈরি করে থাকার সাথে পুজোও শুরু হয় আটটি ভাগে। প্রধান পুজোটি হয় বড়িশা আটচালায়। বাকি পুজোগুলি হয় আটচালা বাড়ি, বড় বাড়ি, মাঝের বাড়ি, বেনাকী বাড়ি, কালীকিঙ্কর ভবনে। এ ছাড়াও বিরাটিতে ও নিমতা পাঠানপুরের সাবর্ণবাড়িতে পুজো হয়। বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তি তরঙ্গিনী মতে, অর্থাৎ তন্ত্রমতে দেবীর পুজো হয়। এই পরিবারের সদস্য বুড়ো রায়চৌধুরী জানান, লক্ষ্মীকান্তের নাতি বিদ্যাধর রায়চোধুরীর সময় এই পরিবারের পুজোতে ত্রিধারাসঙ্গম হয়। অর্থাৎ, শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব— এই তিন মত মিলে যায় পুজোতে।

সাবর্ণ পরিবারে মা দুর্গাকে সপ্ততীর্থের জল দিয়ে আটচালাতেই করানো হয়।আর এই আটচালাতেই একমাত্র কৃষ্ণানবমী কল্পারম্ভে পুজো হয়। মূলত কালীকিঙ্কর ভবনে রথের দিন কাঠামোতে মাটি দেওয়া হয়। কালের গতিতে অনেক কিছু আজ আর খুঁজে না পাওয়া গেলেও কাঠামোটি মতের ওপর রেখে চলেছেন এই পরিবার। এই পুজোর মা দুর্গার মূর্তির চালচিত্রে রয়েছেন ছিন্নমস্তা, বগলা, কমলাকামিনী, মাতঙ্গী, অর্থাৎ দশমহাবিদ্যা এবং সেই সঙ্গে রয়েছেন রাধাকৃষ্ণ। মহালয়ার পরের দিন বেদী করে সেখানে পঞ্চঘট বসানো হয়। পঞ্চমীর দিন ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরে গণেশ ও শান্তির আরাধনা করা হয়। সপ্তমীর দিন যখন পুজো শুরু হয় তখন এই ঘট থেকে মাটি নিয়ে গিয়ে প্রতিমার সামনে মূল ঘটে নিয়ে গিয়ে বসানো হয়।

এক সময় আটচালায় বলির প্রচলন থাকলেও এখন আর হয় না। শোনা যায় বাড়ির পুজোয় ১৩টি ছাগল এবং একটি মোষ বলি হত। তবে কালীকিঙ্কর ভবনের বর্তমান প্রজন্ম বুড়ো রায় চোধুরী বলেন কালীকিঙ্কর ভবনে কোন সময়ই বলির প্রথা ছিলনা। তবে এই বাড়িতে ঠাকুরের ভোগের নানা বাহার। বোধনের পর থেকে এক এক দিন এক এক বাড়িতে দেবীর ভোগ রান্না হলেও সপ্তমীর দিন থেকে পরিবারের মহিলারা একসঙ্গে ভোগ রাঁধেন। সাদা ভাত, পোলাও, খিচুড়ি— এক এক দিন এক একটা জিনিস রান্না করা হয়। এর সঙ্গে শুক্তো, মুগের ডাল, মোচার ঘণ্ট, লাউ, সবই রান্না করা হয় দেবীর জন্য।

কালীকিঙ্কর ভবনে দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে ঠাকুরের সামনেই শুরু হয় বিজয়া পর্ব। মণ্ডপেই প্রণামের রীতি, কিন্তু এই পরিবারের বৈশিষ্ট্য, এই নিয়মের চল অন্য কোথাও নেই। আগে ঠাকুর টলিনালায় বিসর্জন হত। বর্তমানে কালীকিঙ্কর ভবনের পুকুরেই বিসর্জন দেওয়া হয়।

বলা বাহুল্য এই পরিবারের অনেকেই থাকেন কর্মসূত্রে দূরে ও পরিবারের অধিকাংশই কন্যা সন্তান হবার ফলে তারাই এখন এই পুজোর ব্যাটন ধরে রয়েছে। সঙ্গে রয়েছেন জামাইরাও , তারাও নিজেদের কাঁধে দায়িত্ব ভাগ করে নিয়েছেন। সব মিলিয়ে অনেক কথাই যা ছিল অজানা তা আজ সকালের আড্ডায় বেরিয়ে পড়ল।

Show More

OpinionTimes

Bangla news online portal.

Related Articles

Back to top button
%d bloggers like this: