করোনা পরিস্থিতিতে করতে হবে পূজা, কিন্তু কী বলছেন পূজা উদ্যোক্তারা ?
বিধি নিষেধ মেনেই বলা হচ্ছে পূজার কথা, কিন্তু বাড়ছে করোনার সংক্রমণ !
দেবশ্রী কয়াল : বাঙালির আবেগের পুজো দূর্গা পুজো। আর তাকে ঘিরে সারা বছর ধরে মানুষ অপেক্ষা করে। অপেক্ষা থাকে পুজোর ৪টে দিনের। কিন্তু বর্তমানের করোনা পরিস্থিতিতে তা কতটা এবং কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছিল। পূজা হলে তা কিভাবে হবে, আদেও তা সম্ভব কী না সেই নিয়ে জাগছিল বহু প্রশ্ন, হচ্ছিল অনেক সমালোচনা। তবে গত বুধবার, নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী জানান পূজাতো হবেই। এই কঠিন পরিস্থিতিতেও করোনা সংক্রমণ রুখতে নিয়ম মেনে পুজো করতে চাইছেন উদ্যোক্তারা। বিধিনিষেধের কথা মাথায় রেখে থিমের পসরা সাজাতে রাজি শিল্পীরাও।
পূজা তো হবেই, কিন্তু তা মানতে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে বলেই বলছে পরিস্থিতি। কিন্তু এই কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছেন দুর্গাপুজো উদ্যোক্তাদের যৌথমঞ্চ ‘ফোরাম ফর দুর্গোত্সব’-এর সদস্যরা। পূজা মন্ডপে প্রত্যেকটি মানুষ যাতে মাস্ক পরে এবং স্যানিটাইজার ব্যবহার করেন, ক্লাব এবং পুজো উদ্যোক্তাদের সে বিষয়ে নজর রাখার কথা বলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। এই পরিস্থিতিতে পুজোর চার দিন কী ভাবে নিয়ম মানা হবে, তার রূপরেখাও ইতিমধ্যে তৈরি করেছে ‘ফোরাম ফর দুর্গোত্সব’।
করোনা পরিস্থিতিতে তার সংক্রমণকে রুখতে সকল বিধিনিধেষ মেনেই হবে পূজা। কিন্তু জারি হয়েছে বেশ কিছু গাইডলাইন। এই মুহূর্তে কিন্তু কোনো আর আড়ম্বর নয়, থাকবে না কোনো জাঁকজমক। প্যান্ডেল ও প্রতিমার উচ্চতা হবে কম। পুজোর দিনগুলিতে পুরসভার সহযোগিতায় এক বার করে প্রতিমার গায়ে এবং মণ্ডপে জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। খোলামেলা হবে মন্ডপ। যাতে দর্শকেরা বাইরে থেকেই ভাল ভাবে প্রতিমা দর্শন করতে পারেন। প্যান্ডেলের ভেতরের বদলে বাইরের দিকে শিল্পকর্মের উপরে জোর দিতে চাইছেন উদ্যোক্তারা।
কিন্তু কী হবে যদি আগামী দিনে করোনার সংক্ৰমন বেড়ে যায় ? কী প্রস্তুতি নেবেন পূজা উদ্যোক্তারা ? কী তাঁদের পরিকল্পনা ? এই বিষয়ে কথা হয় নানান পুজো উদ্যোক্তাদের সাথে। তাঁরা জানান তাঁদের পরিস্থিতি পরিকল্পনা।
প্রথমেই আমরা কথা বলি, ‘ফোরাম ফর দুর্গোত্সব’ এর জেনারেল সেক্রেটারি শাশ্বত ঘোষের সাথে। তিনি বলেন, ” আমরা দায়িত্বশীল একটি সংগঠন। সমাজের অকল্যাণ হোক বা অমঙ্গল হোক আমরা তা কখনওই চাইব না। করোনার সংক্রমণ পূজা প্রস্তুতিতে বা সেই সময়কালে বেড়ে যাক আমরা তা কখনই চাইব না। মানুষের সুরক্ষার জন্য আমরা ইতিমধ্যেই একটি গাইডলাইন জারি করেছি, জানিয়েছে এক সময়ে মন্ডপে একসাথে মাত্র ২৫ জন প্রবেশ করতে পারেন। তার অধিক কিন্তু নয়। মাস্ক তো পড়তে হবে সবাইকে, মন্ডপের বাইরে হবে থার্মাল স্ক্রিনিং। তবে এই সিদ্ধান্ত কিন্তু এই আজকের দিনে বলা হয়েছে, আগামী দিনে যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে সেই ভাবে পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্তে কিছু পরিবর্তন অবশ্যই আনা হবে। ” আমরা যখন তাঁকে পূজার সাথে জড়িত শিল্পীদের হাল হকিকত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি, তখন তিনি বলেন, ” এই দূর্গা পূজার সাথে কম করে ২-৩ লক্ষ পরিবার জড়িত থাকে। যাঁদের পূজা নিয়ে বহু আশা থাকে। অনেকের রোজগার উঠে আসে এর থেকে। দূর্গা পূজা বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। এখানেই বহু মানুষ টাকা রোজগারের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তা জীবন আর জীবিকার মধ্যে পড়েছে টানাপোড়ন। আগে তো মানুষের জীবন। তাই আশা করা যাচ্ছে সব কিছু নিয়ম মেনেই এক পরিস্থিতিকে জয় করে, আমরা পূজা করতে পারবো। ”
এরপর, ‘ফোরাম ফর দুর্গোত্সব’ এর সভাপতি, কাজল সরকারের সাথে কথা বলি, তিনি বলেন, ” এই পূজা হবে এবং তার সিদ্ধান্ত অবশ্যই যথাযথ। আশা করা হচ্ছে যে গাইডলাইন দেওয়া হয়েছে তা মেনেই সবাই চলবেন। কেউ তার অন্যথা করবেন না। তবে হ্যাঁ, এই প্যান্ডেমিক পরিস্থিতি যা না বাড়ে তার দিকে আমরা বিশেষ নজর দেব। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় সেই দিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা পূজা করব। “
শিব মন্দিরের প্রধান উদ্যোক্তা, পার্থ ঘোষের সাথে কথা বললে, তিনি তাঁদের পূজা পরিকল্পনা নিয়ে বলেন, ” আমরা সেপ্টেম্বর মাসের আগে পূজার কোনো পরিকল্পনা করতে চাইছি না। পুরোটাই এখন নির্ভর করছে পরিস্থিতির উপর। তাই পরিস্থিতি বিচার করেই, আমরা আগামী সিদ্ধান্ত নেব। আশা করছি পরিস্থিতি একটু ভালো হবে, তখন আমরা ছোট করেই পূজা সারতে চাই। ” এই সময় শিল্পীদের সুরক্ষা বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, ” যে সব শিল্পীরা আসবেন পূজার কাজ করতে, তাঁদের সকলের দায়িত্বই পূজা কমিটির তরফ থেকে নেওয়া হবে। যদি কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েন এই সময়ে, তাঁদের টেস্টিং এবং আইসোলেশনের সমস্ত দায়িত্বভার পূজা কমিটির। এবং তার পাশাপাশি তাঁদের জন্য করা হবে হেলথ ইন্স্যুরেন্স। “
এরপর, ৪১ পল্লী ক্লাবের উদ্যোগক্তা দীপঙ্কর চ্যাটার্জীর সাথে কথা বললে তিনি বলেন, ” এখনই নেই কোনো স্পষ্ট পরিকল্পনা। ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত পরিস্থিতি দেখে কোনোরকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। পূজাত হবেই, আর সেটা ক্লাবেই হবে। কিন্তু কিভাবে হবে তা নিয়ে আর্টিস্টদের একটি বৈঠক বসবে। সরকারের সাজেশান মাথায় রাখার সাথে সাথে তো ক্লাবের নিজস্ব একটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে সেই হিসাবেই হবে কাজ। এছাড়া আর্থিক অবস্থা এখন খুব খারাপ। শিল্পী, স্পন্সরদের উপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে। এখন তো আর চাঁদা তুলে পূজা হবে না, এখন অনেকটাই স্পন্সরদের উপর। আর এই পরিস্থিতিতে সবার আগে প্রয়োজন মানুষের চেতনার। ” এরপর পূজাতে যাঁরা কাজ করতে আসবেন তাঁদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কারোর কিন্তু কোনো অসুবিধা হবে না এক্ষেত্রে। সবার আগে মানুষ, তাদের সুরক্ষার দিকে নজর দেওয়া হবে সর্বপ্রথম। “
লালাবাগান নবাঙ্কুর এর উদ্যোক্তা, রাকেশ সাহার সাথে এই বিষয়ে কথা বললে, তিনি বলেন, এই বছর তাঁদের ৬১ বছরের বর্ষপূর্তি। সুতরাং পূজা না হওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠছে না। তবে প্রশ্ন উঠছে কিভাবে হবে সেই পূজা। এখনও পর্যন্ত পাওয়া গাইডলাইন মেনেই সকল বিধি নিষেধ মেনেই করা হবে কাজ। তবে তাঁর মধ্যে যদি এলাকা কন্টেনমেন্ট জোন হিসাবে ঘোষণা করা হয় তাহলে সেক্ষেত্রেও পরিস্থিতি নির্বাচন সব কাজ করা হবে। হ্যাঁ, জাকজমক-আড়ম্বরের ক্ষেত্রে এ বারের পূজা বেশ ধাক্কা খাবে। আর্থিক দিকেও বেশ ঘাটতি থাকবে। তবে সুরক্ষা ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা থাকবে না। সকল নিরাপত্তা বিধি মেনেই হবে পূজার আয়োজন। তবে পূজার আয়োজনের সময় কেউ যদি দুৰ্ভাগ্যবশত করোনা আক্রান্ত হয়ে যান, এক্ষেত্রে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে পূজা কমিটি। “
কেষ্টপুর প্রফুল্লকানন পশ্চিম আদিবাসীবৃন্দের উদ্যোক্তা রঞ্জিত চক্রবর্তীকে পূজা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ” দুর্গাপূজাতো হবে, সুরক্ষার স্বার্থে প্রতিমার স্যানিটাইজকরতে হবে। কিন্তু পূজা ঠিক কিভাবে হবে তার সঠিক চিত্র রেখা কিন্তু এখনও স্পষ্ট নয়। তবে এবারে আর কোনো থিম নয়, পূজাত মানুষের জন্য, কিন্তু এবার কত মানুষ বের হবেন তার তো ঠিক নেই। তা মানুষ না আসতে পারলে থিম করে কী হবে। আর এমনিতেই এবারের পূজাতে কোনো আড়ম্বর থাকবে না, সংক্রমণ রুখতে। ” এরপর শিল্পীদের অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ” অনেকেই এখন এই মুহূর্তে কোলকাতাতে আসতে চাইছেন না, সকলের মনে তো ভয় রয়েইছে। তবে শিল্পীদের সুরক্ষা হিসাবে আমরা তাদের পিপিই কিট দেব, বসানো হবে স্যানিটাইজিং প্যানেল, থাকবার থার্মাল গান। তবে আবারও বলব সবার আগে মানুষের প্রাণ। “
অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে বেশ চ্যালেঞ্জের বিষয় হতে চলেছে এ বছরের দূর্গা পূজা। নিয়ম মেনেই সম্পন্ন হবে দূর্গা পূজা। তবে এই পুরোটাই এখন নির্ভর করছে করোনা পরিস্থিতির উপর। করোনা যদি আরও সঙ্কটময় হয়ে ওঠে, সেইভাবেই কিন্তু পাল্টাবে পরিকল্পনা, পাল্টাবে সিদ্ধান্ত।