
তিয়াসা মিত্র : ” ধর্ষণ ” – শব্দটি শুনলেই যে চিত্র যে ঘটনা গুলি যে কার্যকলাপ গুলি আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ও গায়ের রক্ত গরম হয়ে ওঠে সেই ধর্ষণ। পঁচাত্তরবছরের স্বাধীন ভারতের গণতন্ত্রের মহোৎসব ! কিন্তু কোণে কোণে প্রতিমুহূর্তে প্রতিক্ষনে হয়ে চলেছে গণ তন্ত্রের হত্যা। যে সংবিধান নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য এক, সেই সংবিধানের ঐতিহ্য ধ্বংস করে যাচ্ছে এক নিকৃষ্ট শ্রেণীর মানুষ এবং সৃষ্টি করে চলেছে লিঙ্গ বৈষম্যতা সাথে বর্ণ বৈষম্যতা। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক , পারিবারিক কিংবা বন্ধুচক্রের লালশাময় যৌনতার ধ্বংসখেলা প্রতিনিয়ত অপমানের শিকারে নারী সমাজ। নিরপেক্ষতার সাথে দেখতে গেলে, ঝগড়া দলাদলি এই সবের মাঝে কোনোনা কোনোভাবে প্রভাবিত হচ্ছে নারী। যার ফল স্বরূপ দেখা যায় হাথরসের ঘটনা, নির্ভয়া কান্ড , হায়দ্রাবাদ ধর্ষণ কান্ড, আশিফা হত্যা মামলা, কামদুনির নৃশংসতা আরো কত যে ঘটনা আমাদের চোখের আড়ালে রাতের অন্ধকারে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তার দৃষ্টান্ত ‘ হাঁসখালি ধর্ষণ মামলা ‘ . লেখার ক্ষেত্রে একটু কঠিন কারণ ভাষাতে প্রকাশ করা সত্যি সম্ভব হয়ে ওঠে কি না আমার ঠিক জানা নেই।
যে সরকার শাসনে আসুক না কেন এই ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে ওই বারো বছরের নির্বাসন। নির্ভয়া কাণ্ডের মতন বছর বছর চলতে থাকা মামলা যার শাস্তি ফাঁসি হিসাবে আমরা দেখলেও হাথরসের ঘটনার যে নারকীয়তা তার আসল সত্যতা কোনোভাবেই আমাদের সামনে আসছেনা অর্থাৎ সেই ‘নরপিশাচ ‘ গুলি জীবিত রয়েছে আজ এই দেশের মাটিতে। পুলিশ প্রশাসন আজ বোদ্ধা ‘ ব্যক্তিদের হাতের পুতুলে পরিণত । সবার মনে সৃষ্টি করা আতঙ্ক, ভয়, নিজের বাড়ির মা বোন স্ত্রী-এর ওপর যাতে এরকম না ঘটে সেই ধরণের আতঙ্কের দেওয়াল তুলে দিতে সত্যি সক্ষম
দেশের এবং গণ তন্ত্রের ‘ রক্ষকেরা ‘ . স্বাধীন ভারতের ৭৫-এর অমৃত কি মহোৎসবে অপঘাতে মৃত্যু ঘটছে গনতন্ত্রের। সঠিক বিচার কবে পাবে এ দেশের মানুষ ? প্রশাসনকে কবে আমরা দেখবো নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে ? উত্তরে আমরা একটি বড়ো শুন্যতা পাবো।
যে প্রশ্ন গুলি দেশ তথা রাজ্যের প্রতিটি মানুষের মনে মনে উঠছে – কি ভাবে নেতার ছেলেরা এই ধরণের অমানবিক কাজ করতে পারে ? শুধু কি টাকার এবং গদি এই দুই-এর জোর আছে বলেই কি এই ধর্ষণ বা ধর্ষণের পর যে পাশবিক অত্যাচার তা অনায়াসে করে ফেলতে পারে ? কি ভাবে মেডিক্যাল রিপোর্ট ছাড়া একটি দেহ রাতের আঁধারে পরিবারকে দিয়ে জোর করে পুড়িয়ে ফেলা যায়? এই সমাজে কি প্রশাসনের কোনো ভূমিকা নেই ? তাহলে আমাদের মতন সাধারণ মানুষদের নিরাপত্তা আজ কার হাতে ? এইকি তবে গণতন্ত্র ধ্বংসের শেষ উল্লাস? এই বিষয় নিয়ে আমি কথা বলে নিয়েছিলাম তিনজন বিশিষ্ট মানুষের সাথে।
রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন সদস্যা এবং বিশিষ্ট আইনজীবী শ্রীমতি ভারতী মুৎসুদ্ধি বলেছেন- ” নারীর এগিয়ে যাওয়ার লড়াইয়ে একটি বিরাট পাথর হলো এই ধর্ষণ। জীবনেই সমস্ত ক্ষেত্রে ( বাইরে পড়তে যাওয়া, চাকরি ক্ষেত্রে, বাড়ির অন্দরেও) এই ধরণের অপরাধ সংগঠিত করা হচ্ছে যাতে মেয়েরা মুঁচড়ে পরে। ” তিনি আরো একটি মন্তব্য আমাদের সামনে রেখেছেন যা পৃথিবীর সমস্ত নারীদের মনের কথা- ” একটি নারীকে যখন ধর্ষণ করা হয়তখন তার আত্মার মৃত্যু ঘটে ” এই কথা যে কত পরিমানে সত্যি তা বোঝার ক্ষমতা নারী মনেরই রয়েছে এই সমাজে। ওনার সামনে আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম যে কি ভাবে এই অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি হতে পারে ? তার উত্তরে তিনি জানা- ” আইনের চৌহদ্দি থেকে অপরাধীকে কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি পাওয়াতে হবে। যতদিন না সেই লক্ষে আমরা পৌঁছচ্ছি ততদিন আমাদের শান্তিতে থাকা উচিত নয়। “

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস-এর মহিলা সভানেত্রী ( পশ্চিমবঙ্গ) সুব্রতা দত্ত তার বক্তব্যে জানান- ” ভারতের যে সরকার তিনি যে কথা আমাদের বলেছিলেন ‘ বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও ‘ এর কোনো রকম প্রমান আমরা পাইনি। তিনি মানুষকে বোকা বানাচ্ছেন। ভারতবর্ষ সরকার পুলিশকে দিয়ে দেহ রাতারাতি পুড়িয়ে দেওয়া , পরিবাকে চুপ করিয়ে রাখা এই কাজ গুলি করিয়ে নিচ্ছেন। এবার যদি বাংলার দিকে কথা বলি সেটি আরো লজ্জার কারণ এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা কিন্তু সেই রাজ্য ধর্ষণের দিক থেকে এগিয়ে থাকে। সব থেকে নিন্দনীয় এই রাজ্যের মেয়েগুলিকে অকারণে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হচ্ছে এবং ধর্ষকদের কোনো শাস্তি হচ্ছে না। যা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যে রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী মহিলা সেই রাজ্যে নারীরাই নিরাপদ নয়। প্রশাসন শাসক দলের তাবেদারী করছে যা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। “

বাংলাচলচিত্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী পাপিয়া অধিকারী এই বিষয়ে জানান- ” রাজ্য সরকার এই ঘটনা গুলি সামাল দিতে অপারক। যে নৃশংসতা আমাদের সামনে উঠে আসছে তা সত্যি ধিক্কারজনক। রাজ্যের শাসকদল ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেন ( নির্বাচন পরবর্তি হিংসা ) আমাদের উচিত এই সরকারকে সরাসরি গোড়া থেকে উপরে ফেলা। “

সরকারি দোলাচল হোক কিংবা দলীয় হিংসা, সব শেষে মানুষের সন্মান এবং তার নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে পরবর্তী সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। হয় কোর্টের কাছে হাঁসখালি ধর্ষণ ঘটনার জনস্বার্থ মামলা দায়ে করা হয়েছে ইতিমধ্যে , এই নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী অনিন্দ সুন্দর দাস জানান- ” আমরা এই মামলা দায়ে করেছি কারণ- অপপরাধীদের অবিলম্বে শাস্তি এবং কঠোর শাস্তির আর্জি জানিয়ে ডিভিশন বেঞ্চের কাছে জনস্বার্থ মামলা দায়ে করা হয়েছে। কাল সকাল ১০.৩০ নাগাদ শুরু হবে শুনানির কার্য। “
গণতন্রের মহোৎসবে প্রতিক্ষনে গণতন্ত্র হত্যা হচ্ছে এবং মানুষের যে আইনের ওপর থেকে আস্থা হারিয়েছে অনেকাংশে তার দৃষ্টান্ত দিয়েছে প্রাক্তন বিএসএফ সেই বাবা যে নিজের মেয়ের ধর্ষকের বেকসুর খালাসে কোর্টের সামনে গুলীৱিদ্ধ করে হত্যা করে মেয়ের ধর্ষককে । এর অর্থ এই দাড়ায়ে, ভারতের আইন ব্যবস্থার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়েছে ভারতবাসীর । তবে এই বিষয়ে যে স্বাধীন ভারতের কতবড় লজ্জার বিষয় তা বলে প্রকাশের নয় ।