বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও … প্রশ্নের মুখে রামভূমি
পিতৃপক্ষের অবসান আর দেবীপক্ষের সূচনায় আজকের দুর্গারা দিকে দিকে ধর্ষিত, রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসকরা মুখে কুলুপ এঁটেছে প্রশ্নের মুখে সরকার
দেবশ্রী কয়াল : যে রাজ্যে খোদ সীতারা সুরক্ষিত নয়, প্রতিনিয়ত তাদের হতে হচ্ছে নির্যাতনের শিকার, সেই রাজ্যে হচ্ছে রামের পূজা। গত ৫ বছর আগে ২০১৫ সালে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কর্মসূচির সূচনা হয় ২২ জানুয়ারি হরিয়ানার পানিপথে। এর সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং। কন্যাসন্তানের জন্মহার ক্রমশ হ্রাস পাওয়া এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলির কার্যকর মোকাবিলায় এই কর্মসূচিটির কথা পরিকল্পনা করা হয়। এরই পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে যুক্ত করা হয় এই কর্মসূচির বিশেষ ধারণাটির সঙ্গে। কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে কোথায় সুরক্ষিত বেটিরা ? কেবল তাঁদের জন্ম আর শিক্ষার কর্মসূচি করছে সরকার, কিন্তু তাঁদের জন্মের পর থেকে তাঁদের সুরক্ষার কথা ভাবছে না কেউই। তাই প্রতি মুহূর্তে নিরাপত্তার অভাবে ভুগতে হচ্ছে বেটিদের।
বেটিদের সাবলম্বী ও শিক্ষিত করে তোলার এই প্রকল্পে প্রথম প্রথম মিলতে শুরু করে ব্যাপক সাড়া। তারপর থেকে চলতে থাকে এই প্রকল্পের রমরমা। চলতি বছরের বাজেট পেশ করতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণ সংসদে দাবি করেন, ১৫ বছরের নীচে কন্যা সন্তান যারা, তাঁদের পরিবারকে থেকে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। প্রাথমিক এবং উচ্চপ্রাথমিকে নাবালকদের থেকে নাবালিকারা বেশি এই প্রকল্পে নাম লিখিয়েছেন। যেখানে গোটা দেশে ৮৯.২৮ শতাংশ ছাত্রের নাম নথিভুক্ত হয়েছে, সেখানে ছাত্রীদের শতাংশ ৯৪.৩২। ২০২০-২১ সালের জন্যে এই প্রকল্পে মোট ২৮,৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। অর্থাৎ যেখানে তাঁদের শিক্ষার জন্যে, স্বাস্থ্যের জন্যে এত টাকা খরচ করছে সরকার, সেখানে কেন নিরাপত্তা টুকু দিতে পারছে না কেন্দ্রীয় সরকার ? কেন রাতের অন্ধকারে বাড়ি ফিরতে গেলে ভয়ে কাঁপতে হবে বেটিদেরকে ? স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন স্বাধীন নয় তারা, প্রশ্ন সকল বেটিদের।
উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যাতে রামরাজ্যে রাম এর পূজার জন্যে এত আন্দোলন এত লড়াই হয়, কিন্তু আজ সেই রামভুমিতে যখন হাথরস থেকে বলরামপুর আর সেখান থেকে বুলন্দ শহর মেয়েরা ধর্ষিত হয়ে মারা যাচ্ছে, কাউকে নৃশংস ভাবে খুন করা হচ্ছে, আবার কেউ ছোট্ট নাবালিকাকেও ধর্ষণ করার জন্যে পিছু পা হচ্ছে না। তখন কেন হাত গুটিয়ে এরা ? কেন বলছে না কোনো কথা ? এই রাজ্যে বিজেপি শাসন ব্যবস্থা, আর তারাই চালু করেছিল ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্প কিন্তু আজ সেখানেই সবথেকে বেশি পরিসংখ্যায় ধর্ষণ হচ্ছে। আজ বাল্মীকিকে নির্মম ভাবে নির্যাতন করে খুন করে ফেলে রাখছে, তা আবার সেই রাজ্যের ওপর এক অঞ্চলে ধর্ষিত হচ্ছে আর এক দলিত কন্যা। কোথাও বা পরিবারের অনিচ্ছাকৃত সত্বেও প্রমান লোপাট করার জন্যে গভীর রাতে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে এক ১৯ বছরের তরুণী বেটিকে। প্রায়ই উত্তরপ্রদেশ থেকে উঠে আসে ধর্ষণের নির্মম ঘটনা। কিন্তু শাস্তি পাচ্ছে কজন ? আর কত গুলি অভিযোগই বা লিখিত ভাবে দায়ের হয় ? উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন আবারও এই ঘটনা ঘটলে কাউকেই রেহাই দেওয়া হবে না কিন্তু, তাও বারবার ঘটছে এই নির্মম ঘটনা। বারবার ধর্ষিত হচ্ছেন রামভূমির সীতারা। ২মাসের শিশু থেকে ৭০ বছরের বৃদ্ধা হন ধর্ষিত, প্রতি মুহূর্তে হন নির্যাতিত। কিন্তু এখানে প্রশাসনের ভূমিকা কী ? প্রাশাসন কী মুখ বুজে অন্যায় দেখার জন্যে রয়েছে কিংবা বর্তমান হাথরসের ঘটনা দেখলে বলা ভালো প্রাশাসন নিজে অন্যায় করছে !
না, এই ঘটনা কেবল এই একটি রাজ্যে ঘটে না। এই ঘটনা দেশে প্রতিদিন ঘটতে থাকে কোনো না কোনো রাজ্যে। যদি ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো এর সমীক্ষা খতিয়ে দেখা যায় তাহলে এটি সাফ যে প্রত্যেক বছর ৫০-৬০ হাজার মেয়ে গোটা দেশে ধর্ষিত হয়। তবে এই সমীক্ষা তো কেবল দায়ের করা অভিযোগের ভিত্তিতে, এমন আরও বহু ঘটনা রয়েছে যেগুলির অভিযোগ দায়ের করা হয় না, অনেক সময় প্রাশাসন দায়ের করতেই চায় না। প্রমান চাওয়া হয়। সম্প্রতি হাথরসের ঘটনায় নির্যাতিতা মারা যাওয়ার পর কোনো এক পুলিশ কর্মীকে এও বলতে দেখা যায় যে ধর্ষণ হয়েছিল তার প্রমান কী ! তাহলে দোষের ভাগিদারীকে ? যেখান প্রশাসনকে মানুষের সুরক্ষার স্বার্থে রাখা হয়েছে সেখানে তারাই যাচ্ছে জনতার বিরুদ্ধে। এ কোন দেশে আমরা রয়েছি ? এ তো লজ্জার ভারতবর্ষ।
এই প্রসঙ্গে বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তীকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ” এই রকম ঘটনাতো কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের বুকেও দেখা যাচ্ছিল যেখানে সরকার তা ধামা চাপা দিয়ে রাখছিল। তবে উত্তরপ্রদেশের এই ঘটনা বুঝিয়ে দিল তারা কোনো অংশে কম নয়, এই অপরাধের প্রতিযোগিতায় তারা পশ্চিমবঙ্গকে টেক্কা দেওয়ার জন্যে রয়েছে। কিন্তু সরকার তো ধামা চাপা দিতে চাইছে সকল ঘটনা, সেখানে জন সাধারণ আর কোথায় যাবে ? আর আজ তো নির্যাতিতার পরিবারের সাথে রাহুল গান্ধী দেখা করতে গেলে রাস্তায় আটকে বলা হয় জারি হয়েছে ১৪৪ ধারা, প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। পরে এই সরকারই বলবে ২৫ লক্ষ টাকা আর চাকরি দিয়ে দেব। আর সিট যখন সাক্ষাৎকারে যাচ্ছে সেখানে পর্যন্ত সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, তার মানে তো এটাই যে, তারা এগুলো লোকাতে চায়। এই সব বলে কদিন পর মানুষের মন ভুলিয়ে রাখতে চায়। এরা চায় না মানুষ সত্যিটা জানুক, এরা কেবল অপরাধ কে ধামা চাপা দিতে জানে। নাহলে নির্ভয়া কাণ্ডের অপরাধে দোষীদের শাস্তি দিতে ৭ বছর লেগে যায় ? আর শাস্তির পরেও তো অপরাধীরা কিছু শিক্ষা পাচ্ছে না। উল্টে ভাবছে ক্রাইম করলেও যখন ধামা চাপা দেওয়া হচ্ছে তাহলে তারা করতে পারে, কারন এটা তাদের সরকার। “
এরপর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন করা হলে সুজন চক্রবর্তী বলেন, ” এটি তো একটি মুখোশ সরকারের। স্লোগানের আড়ালে তারা মানুষকে ঠকাচ্ছে। ক্রাইম আর ক্রিমিনালকে ব্যবহার করছে তারা নিজেদের রাজনীতির খেলা খেলার জন্যে। সবই ভোটের জন্যে তাঁদের প্রচার, মানুষের সুরক্ষার্থে তারা নেই, তারা কেবল অন্যায়কে লুকিয়ে রাখতে চায়। “
সত্যিই তো, যাদের উপর আজ জনসাধারণের দায়িত্ব, তারাই হাত গুটিয়ে রয়েছে। এত গুলি যে প্রাশাসনিক পদ রয়েছে মেয়েদের সুরক্ষার জন্যে তারা কী করছে ? কেন অপরাধীরা শাস্তি পাচ্ছে না, আর পেলেও হয়ত কখনও জরিমানা বা কয়েক বছরের জেল। আর খুব বেশি হলে যাবতজীবন জেল। তবে হ্যাঁ নির্ভয়া কাণ্ডের ক্ষেত্রে শাস্তি পেয়েছে, কিন্তু তার জন্যেও অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ অনেক গুলি বছর। তাঁর মা কে শুনতে হয়েছে অনেক গুলি কটূ কথা। অপরাধীদের হয়ে কথা বলে গেছে বছরের পর বছর আইনজীবীরা। যেভাবে সারা দেশে ধর্ষণ কাণ্ডের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, তা সত্যিই ভাবনা জাগানোর মতো। কামদুনি থেকে, পার্কস্ট্রিট, ডুয়ার্স, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ,তামিলনাড়ু, থেকে বিহার এই রকম আরও বহু রাজ্যে প্রতিদিন হয়ে আসছে মেয়েরা ধর্ষিত। কিন্তু কেন, প্রাশাসন কেন দিতে পারছে না সেই নিরাপত্তা ? স্বয়ং প্রাশাসন, নেতা-নেত্রীরা যদি এত সুরক্ষার সাথে বের হতে পারে, তাহলে জনতার জন্যে তারা কী নিরাপত্তা দিতে পারে না ? যাদের জন্যে তারা আজ ক্ষমতার গদিতে বসে তাদের সুরক্ষার কোথায় ভাবছে না প্রশাসন। মানুষ কিন্তু প্রশ্ন তুলছে, তারা উত্তর চাইছে তারস্বরে। কবে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন হবে এই দেশ ? কবে দেশের বেটিরা বাড়ির বাইরে বের হতে আর ভয় পাবেন না ? আজ সরকার চুপ থাকলেও একদিন না একদিন কিন্তু তাঁকে জবাব দিতেই হবে জন সাধারনের। তখন যে সরকারি থাকুক না কেন। ভোটের আগে হোক কিংবা সরকার গঠনের পরে সংবিধানের সামনে মেয়েদের সুরক্ষার জন্যে, তাদের শিক্ষার জন্যে যে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ প্রকল্প থেকে কন্যাশ্রী প্রলেপ হচ্ছে তা প্রতিনিয়ত কিন্তু লঙ্ঘিত হচ্ছে। বর্তমানে আজকের দুর্গারা প্রতিনিয়ত হয়ে চলেছে ধর্ষিত। প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত করা হচ্ছে দেশের সংবিধানকে, আর তা হচ্ছে এই রাষ্ট্রের শাসকদের দ্বারাই। নির্বাক প্রাশাসন। রাজনৈতিক ঔদ্ধত্য সংবাদ মাধ্যমের গলা চিপে ধরেছে, বিচার ব্যবস্থাও মানুষের বিশ্বাস অর্জনে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন তুলছে আগামী কোন পথে !